যেমন আছি ঢাকায়: "এই শহর জাদুর শহর"

১.

প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে ঢাকায় আসা ২০১৩ সালে, জে.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে। খুব আগ্রহ নিয়েই এসেছিলাম।

বন্ধুরা সবাই ঢাকায় গিয়েছে, বসুন্ধরা সিটি , টিএসসি, কেএফসি, শাহবাগ... ... এসব কতশত গল্প শুনে তো আর চুপ থাকা যায়না। যদিও ততদিনে আমার কুড়িখানেকের ও বেশি জেলা বেড়ানো শেষ। ঢাকার উপর দিয়েই যাওয়া , কিন্তু জানালার ঝাপসা কাঁচ আর অন্ধকারের সে দেখায় কি আর প্রান ভরে। তখনকার অভিজ্ঞতা বলতে এতটুকুই মনে আছে যে, আমি ভোরবেলা বাসে ঘুম থেকে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখি কতশত বিল্ডিং, আগ্রহ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, আমার কৌতূহলী চোখ দেখে বাবা বলেছিল "দেখ, এটা সাভার, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের প্রধান অঞ্চল..." কতক্ষণ হবে মিনিট বিশেকের বেশিতো নয়।

সে দেখায় কী আর চারশ বছরের পুরনো এই জাদুর শহর 'দেখা' হয়!

২.

সবে তখন ‘নীলসাগর’ চালু হয়েছে। নিয়মিত স্থানীয় সাপ্তাহিক-দৈনিক পত্রিকা পড়ি, আমার শহরের তৈরি ট্রেন এই গর্ব হওয়ার মত বুঝ হয়েছে, কাজেই গর্বে ভরা দুরুদুরু বুক নিয়ে খালুর সাথে চড়ে বসলাম নীলসাগরে ট্রেনে, রাত ১১টায় ছাড়ে সৈয়দপুর থেকে। খালু আমার ঢাকায় থাকেন আবার সৈয়দপুরেও থাকেন, ব্যবসার কাজে প্রায়শই যাওয়া আসা করতে হয়।

বেশ ঝকঝকে ট্রেন , তারউপরে আবার ফার্স্টক্লাস বার্থ, তবে খালুকে বেশ ভয়ই করতাম বলা যায়, কাজেই চুপচাপ থাকলেও বেশ আনন্দই লাগছিলো । একটু পরে বাঙ্কবেড এ বিলাসী ঘুম দিলাম, ঘুম থেকে উঠে দেখি ঢাকা প্রায় চলে এসেছি। তখন সকাল ৬টা মত বেজেছিলো হয়তো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই, একটু পরে যখন বিশাল বিশাল(তখনকার হিসেবে) ঘিঞ্জি বিল্ডিং গুলো দেখা যাচ্ছিলো, আমার মুখ তখন কার্যত হাঁ!

এ কোথায় এলাম! অদ্ভুত এক অনুভুতি। এখন যা ভোঁতা হয়ে গেছে বটে।

মফস্বলের ছেলে হিসেবে পত্রিকা মারফত জানতাম, ঢাকায় গাছ নেই, খোলা যায়গা নেই, নোংরা , ঘিঞ্জি...... যত্তসব! কিন্তু যখন এসব কিছুই খুব বেশী দেখলাম না অবাক হলাম বটে।

খালা বাসা উত্তরায় , কাজেই আমার তো বরং বিদেশ বিদেশ লাগছিলো, গাছ আছে, সুন্দর রাস্তা, আহা! আহা!

তখন নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা আমার দিকে কটাক্ষ করেছিলেন, যার ফল এখন ভোগ করছি!

সেবার মাসখানেক ছিলাম ওখানে। অদ্ভুত সুন্দর ছিলো সময়গুলো। বন্দী জীবনের যে কথা শুনেছিলাম তারো একটু আভাস পাচ্ছিলাম, তবে খুব খারাপ ছিলাম না। খালাতো ভাইয়ের জেএসসি প্রস্তুতিতে সাহায্য করে, কাকডাকা দুপুরবেলা গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে , মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে অবাক হয়ে দিনগুলো বেশ কেটেছিল।

এরপরে আরো কয়েকবার আসা হয়েছিলো ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী দুই বছরে। ম্যাথ অলিম্পিয়াড, ফিজিক্স অলিম্পিয়াড , চিল্ড্রেন সায়েন্স কংগ্রেস ইত্যাদি নানা আয়োজনে। প্রত্যেকটাই একেকটা আলাদা গল্প। কখনো বাবা বা মামার সাথে, আর পরের বছরতো একা-ই এসেছিলাম (এখন মনে হয়- কীভাবে অত পিচ্চি আমার ল্যাপটপ , ব্যাগপ্যাক কাঁধে একা আসার সাহস হয়েছিলো। তাও আবার এই মতিঝিল পর্যন্ত!)

৩.

যেবার আমি ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে ২০১৩ সালে ঢাকায় আসি, উঠেছিলাম বন্ধু নুওয়াইসিরের খালার বাসায়। সেও ন্যাশনালে সুযোগ পাওয়ায় আমার জন্য ভালোই হয়েছিলো। ওর বেড়ে ওঠা যদিও ঢাকাতেই।

আমি একা একা যখন বিআরটিসি বাস (ওহ! বলা ভালো, আমার কেন জানি বিআরটিসি বাস খুব ভালো লাগে। দেখতে ভালো হয়তো একারনে! কাজেই বিআরটিসি ছাড়া কোনো বাসে উঠতাম না ) থেকে শাপলা চত্বরে নামলাম , সুহাইলের কাছে নির্দেশনা নিয়ে মতিঝিল গভমেন্ট বয়েজ স্কুল পর্যন্ত যাওয়ার পথে কোন কুক্ষনে বা নটরডেম কলেজে চোখ পড়ে গিয়েছিল।

কিছুই ভাবিনি তখন! জানতাম ও না এই কলেজের মাহাত্ব কী! এও জানতাম না যে, দু'টি বছর পর এই কলেজে অধ্যয়ন করব কীংবা এই এলাকাই হবে আমার সামনের দিনগুলোর ঠিকানা! আজ যখন ফিরে তাকাই পিছনে, থমকে উঠি।

কী এক জীবন, কীইবা তার রুপ, কত ভাবেই না চমকে দেয় আমাদের!

৪. 



সদরঘাট
ছবিঃ সৈয়দ জাকির হোসাইন/ ঢাকা ট্রিবিউন 

দু’টি বছর পার করলাম এই শহরে।

সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী এর মাঝে কতবার চক্কর দিল, কত মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লো, কত চাঁদ এলো আর চলে গেল।

গুলিস্তানে যখন কেউ বসে বাস চালকের মুণ্ডু নিপাত করে, কেউ তখন চারুকলায় ছবি আঁকে ,মতিঝিলের গগন ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকা বিল্ডিং এর জানালা দিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত ব্যাংকার বাইরে তাকায়, লেগুনার পেছনের ছোট্ট সহকারীটি অক্লান্ত গলায় চিৎকার করতেই থাকে, চাংখার পুলের সামনে অস্থিসার মাদকসেবীরা ইনজেকশনে বুঁদ হয়।

শহরে আর্ট প্রদর্শনী হয়, ফোক ফেস্ট হয়, শিল্পকলায় নাটক হয়, লিট ফেস্ট হয়; বাংলা একাডেমিতে শক্ত মুখ করে সুশীল সমাজের মানুষেরা ঘুরে বেড়ায়, টিএসসিতে আড্ডা হয়। সায়েদাবাদ , গাবতলি ,কমলাপুর ক্ষণে ক্ষণে মানুষে ভরে উঠে।

যান্ত্রিক অভিঘাত, অনিকেত মনোবৃত্তি, অনিশ্চয়তা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের কতগুলো অনুভুতি নাগরিক সমাজের ঋদ্ধতার সঙ্গী হয়। 

সবাই ছুটে স্বপ্নের পেছনে। কারোটা বানানো স্বপ্ন, কারোটা শুদ্ধতম, আর কারোটা শুধু স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হয় বলেই স্বপ্ন।স্বপ্ন না দেখতে পারলে এই স্রোতে কেউ টিকবেনা। না ঐ গার্মেন্টস কর্মী তরুণী, না এই আমি। 


তাই সবাই স্বপ্ন দেখে। 'দ্যা আমেরিকান ড্রিম' এর মত দ্যা বাংলাদেশি ড্রিম। 

৫।

এত ব্যস্ততা, এত উত্তেজনার এই শহরে আমার মত কতক মানুষ আছে যারা আয়নায় নিজেকে আর চোখে বাকিদের দেখে বেড়ায়।

চলন্ত পথে, ফুটপাতে, হাইকোর্টের সামনে, ওভারব্রীজের উপর, ব্যালকনিতে দাড়িয়ে হঠাৎ হঠাৎ এদের মতিভ্রম হয়। কাঁকের তীব্র চিৎকার এদের ডুবিয়ে দেয় একটা সমান্তরাল কিন্তু ভিন্ন এক জগতে, মনে হয় যেন পৃথিবীর সব ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে, সময় স্থির , হৃদপিণ্ড থমকে গেছে।

গুলিস্তানের বাতির বিজ্ঞাপন, বাসের সহকারীদের চিৎকার, যুবক যুবতীদের অভিসার… সব।

সব যেন স্থির ফ্রেমে শব্দহীন এক ছবি।

কখন ভালোবাসা উপচে পড়ে বুকে, কখন বা বিরাগে-বেদনায় বুকটা শুন্য হয়ে যায়, বিষণ্ণতার মেঘ উড়ে আসে। 

এমনি করে কাটে দিন এই জাদুর শহরে... ... 




Comments

Post a Comment