বিদগ্ধ এক জনপদ: আমাদের বিজ্ঞান আয়োজন ও আশার আলো!

১।

শুনেছি, আমেরিকার গড়পড়তা মানুষজনের পৃথিবীর জিওগ্রাফি সম্পর্কে ধারনা মোটামুটি আহাম্মক ধরনের হয়। ঠিক বিশ্বাস না হলেও মাঝে মাঝে বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা দেখে মনে হয়, ব্যাপারটা খুব অসম্ভব কিছুও নয়।

ছোট্ট একটা দেশ আমাদের। এত ছোট যে, চাইলে একদিনে দেশের এমাথা থেকে ওমাথা গিয়ে ফিরে আসা যায়। উড়োজাহাজে দেড়ঘণ্টা মত লাগবে হয়তো।

যখন আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে বাড়ি কোথায়; ‘সৈয়দপুর’ বললে যদি কেউ না চেনে , আমার খুব বিরক্ত লাগে। তারপর বলতে হয় নীলফামারী, এরপরেও যারা আহাম্মক ধরনের তারা বলে বসে, এটা আবার কোথায়। মুখ শক্ত করে বলি, উত্তরবঙ্গ-রংপুর-দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়; তখন তারা বলে “ও! এবার বুঝছি!”

অথচ ব্যপারটা এমন হওয়ার কথা মোটেই ছিলনা।


২।

বাংলা উইকিপিডিয়ায় সৈয়দপুরের পাতায় গেলে দেখা যায়, “তদানিমতন পূর্ব পাকিস্তান আমলে সৈয়দপুর সিটি টাউন ছিল। কালের চক্রে তাহা বিলুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সিটি টাউনের চেয়েও কাজে কর্মে জেলা শহরের রুপ নিয়াছে।” 

অথচ, এ শহরে একটি সেনানিবাস আছে, বিমানবন্দর আছে, বাংলাদেশের একমাত্র ই.এম.ই সেন্টার ও স্কুল আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি উপ-বিভাগ রয়েছে। একটি ছোট আকারে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রও রয়েছে। এখানে একটি বিসিক শিল্প এস্টেট রয়েছে। আছে দেশের সবথেকে বড় রেলওয়ে কারখানা।

সব বাদ দিয়ে,শুধু বলি- সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে নিয়মিত চারটি এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ চলাচল করে! সামনে এটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রুপ নেবে।

রেলওয়েকে কেন্দ্র করে এ শহর গড়ে উঠলেও সময়ের বিবর্তনে এ শহর উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। পরিবহনের ক্ষেত্রে সৈয়দপুর বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুরসহ ৮টি জেলার করিডোর বা নার্ভ সেন্টার হিসেবে পরিচিত।

কাজেই , আমরা যদি হাতিয়া চিনি ,মনপুরার চর চিনি; কিন্তু সৈয়দপুর না চিনি- আমার বিরক্ত হওয়ার যথেষ্ট ভালো কারন আছে।


৩। 

প্রখ্যাত নাট্যনির্মাতা ও আনন্দআলোর সম্পাদক জনাব রেজানুর রহমান ‘দৈনিক সাফ জবাব’-এ “জাগো বাহে...।” শিরোনামে সাপ্তাহিক কলাম লিখতেন। তার ঋদ্ধ লেখনি আমাকে বেশ চিন্তার খোরাক এনে দিত।

সেখান থেকে জেনেছি, সৈয়দপুরেও একসময় অনেকটা ঢাকার শাহবাগ কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মত একটা অতি চমৎকার আবহ ছিল। শিল্প-সাহিত্য সংসদ ছিল, ছিল নাট্যদল, সঙ্গীতচর্চা ,ছিল পুবালী বিজ্ঞান ক্লাব। 

“১৮৮৬ সালে সৈয়দপুরে ব্রিটিশরা ইংরেজি সংস্কৃতি ধারার প্রবেশ ঘটান। তখন এখানে গড়ে ওঠে বিশাল ইউরোপিয়ান ক্লাব, ব্যাকপাইপার ইনস্টিটিউট। এর বিশাল মঞ্চে টুইস্ট, বল ড্যান্স ও জ্যাজ হতো। কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তো প্রায় সবাই ছিলেন ব্রিটিশ-ইউরোপীয়। লোকশ্রুতি আছে, ইউরোপীয়দের ওই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কোনোভাবেই বাঙালি তথা এ জনপদের মানুষ অংশ নিতে পারত না। কলকাতার বাঙালি বাবুরা ইংরেজি ও উর্দু সংস্কৃতির সমান্তরালে নিজেদের সংস্কৃতির উদ্ভাসন চাইলেন। ওই বাবুরাই ১৯১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সৈয়দপুরে গড়ে তোলেন বাঙালি চর্চা কেন্দ্র ‘দ্য নিউ ইউনিয়ন মিউজিক্যাল ক্লাব’। সেদিনের ওই ক্লাব আজকের শিল্প-সাহিত্য সংসদ”

সেই মফস্বল শহরে চমৎকার সব নাটক হত, হত ভাওয়াইয়া গানের আসর , মর্তুজা ইন্সটিটিউট মেতে থাকতো মনন চর্চায়। 

আজ কাগজে কলমে কিছু অবশিষ্ট থাকলেও বেশিরভাগই অতীত। সেই আবহও নেই, নেই সেই উম্মাদনা। এমনকি অতীত ইতিহাসটুকুও জানা নেই সিংহভাগ মানুশের।

বেশিরভাগ তরুণরাই জানেনা এই কথাগুলো, তারা জানেনা এই সেই শহর যেখানে মুক্তিযুদ্ধে একটা সম্পূর্ণ ট্রেইন ভর্তি প্রায় ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তারা ভুলে গেছে মাহতাব বেগ-এর কথা।


৪।

শিক্ষানগরী হিসেবে খ্যাত সৈয়দপুর। পাবলিক পরীক্ষায় বোর্ডের সেরা তালিকায় থাকা এখানকার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।

তারপরেও আমার খুব খারাপ লাগে, গণিত উৎসব- পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড- শিশু কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেসে সৈয়দপুরের শিক্ষার্থীদের অতি স্বল্প উপস্থিতি দেখে। প্রথমদিকে যখন একা একা ‘দূরের’ রংপুর-দিনাজপুরে একা যেতাম, খুব খারাপ লাগতো।

১৫০ কি.মি. দূরে ঠাকুরগাঁও গিয়ে রেজিস্ট্রশন করার গল্প আরেকদিন করা যাবে।

এখন একটু একটু করে সবাই সচেতন হচ্ছে, বুঝতে পারছে- হাজারো জিপিএ ফাইভের ভীরে এমনি করে আর টিকে থাকা সম্ভব নয়।

কিছুদিন আগে ভাষা প্রতিযোগে সৈয়দপুর প্রথমবারেরই শ্রেষ্ঠ ভেন্যু নির্বাচিত হয়েছে। গণিত উৎসব সহ বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় শিক্ষার্থীরা এখন সৈয়দপুরেই রেজিস্ট্রশন করতে পারে।


আরও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকারে।
ছবি: ওমেগা প্রাইম 


৫।

বিজ্ঞান কংগ্রেসের টানা চারবার অংশগ্রহণকারী এবং ক্যাম্পার হিসেবে আমার জন্য সৈয়দপুরের একটা অ্যাক্টিভেসন প্রোগ্রাম করা মোটামুটি ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

পাশের দিনাজপুর থেকে তামান্না ইসলাম ঊর্মি আপু এমআইটি চলে গেলে একটু তো আক্ষেপ হওয়াই উচিত! আমরা যখন ইশকুলে পড়তাম, ছোট থাকায় কেউ সাহায্য করতোনা (হাফিযুর রহমান খান স্যারের মত অমায়িক মানুষদের কথা বাদ দিলে), ফলে আর কিছু করা হয়নি।

কাজেই, আমার বন্ধুদের কাছে ওমেগা প্রাইমের, “চলো তৈরি করি আরও বাসযোগ্য একটি পৃথিবী” ক্যাম্পেইনের কথা শুনি, কোন দ্বিধা না করে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। মোক্ষম সুযোগ যাকে বলে।

একটা আয়োজন কখনোই সহজ নয়। স্টেজের পেছনটা সবসময়ই কঠিন, যা সামনে থেকে কেউ ধারনাও করতে পারবেনা।

আগে আমি ভাবতাম ইশিজু ভাইয়ারা এত কষ্ট করে এসব ইভেন্ট করেন কেন।

সত্যি বলতে কী, এটা বোঝার জন্য আমাকে ১০০০ এর উপরে বই পড়তে হয়েছে এবং মোটামুটি ১৭ বছর সময় লেগেছে।

“শেয়ারিং নলেজ ইজ পাওয়ার”- খুব সহজ একটা কথা নয়।

নোবেল ভাইয়া বলেন,

“আমাদের দেশের অনেক সমস্যা রে।
আমাদের দেশের আসলে কী দরকার, জানিস? চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা, বিজ্ঞান চিবিয়ে খেয়া ফেলা মানুষ যে খুবই দরকার—এমন কিন্তু না। এর চেয়ে বেশি দরকার ভালো মানুষ। খুব ভালো কিছু মানুষ। যে সবাইকে ভালোবাসবে। কারও প্রয়োজনে যে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসবে। তার চারপাশে দৌঁড়াতে থাকা মানুষগুলো যদি হোঁচট খায়, তাহলে নিজে দৌঁড় থামিয়ে মানুষগুলোকে হাত ধরে টেনে তুলবে।”   



চলছে বৈজ্ঞানিক প্রেজেন্টেশন
ছবি: ওমেগা প্রাইম 

৬।

ঢাকা যাওয়ার পর ক্রমে ক্রমে আমার ধারনা পোক্ত হচ্ছিল যে ঢাকার বাইরে সবাই কত পিছিয়ে থাকে। ঠিক মিথ্যা নয় ধারনাটা।

কিন্তু একটু সাহায্য আর নির্দেশনা পেলে তারা কি করতে পারে, ব্যপারটা জেনে আমি মুগ্ধ।

এইতো এক সপ্তাহ আগেও আমি একটু আধটূ নিরাশাবাদী মানুষ ছিলাম।

কিন্তু আজ যখন, “তুমি কি যেখানে সেখানে ময়লা ফেল? এ বিষয়ে আগে কখন ভেবেছ?

একটা চিপস খাওয়ার পর ডাস্টবিন না পেলে কি করবে?”-প্রশ্নের উত্তর আসে “হ্যাঁ, আসলে আগে ফেলেতাম। আসলে এ বিষয়ে কখনো ভাবা হয়নি, তবে এখন থেকে ডাস্টবিন না পেলে পকেটে রাখব, পরে পুড়িয়ে ফেলব অথবা ডাস্টবিনে ফেলব।,” একটা মেয়ে যখন প্রশ্ন করল, “আমার বাবার প্লাস্টিকের কারখানা আছে, আমি বাবাকে বললাম তুমি যে এই কাজ করো পরিবেশের ক্ষতি হয়না? ... আমরা সব প্লাস্টিক কেন রিসাইকেল করতে পারিনা?” কিংবা, একজনকে বলতে বলেছিলাম সে কেন এখানে এসেছে।

উত্তরে যা বললো ,আমার ততক্ষণে হতভম্ব হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ভিএনএস থেকে আমাদের টেকনিক্যালের মেয়েরা কম কিসে?

কোন পূর্ব ধারনা ছাড়া এত সুন্দর প্রেজেন্টেশন কিভাবে করল ওঁরা!

ক্লাস সিক্সের ছেলেদের প্রশ্ন শুনে আর উত্তর দেখে আমি শুধু নোবেল ভাইয়ার মত ভাবছিলাম,

“এত আলো চারদিকে!”

আপনারা বিশ্বাস করবেন, এই ভয়ংকর শীতে ও কুয়াশায় তারা সকাল ৮টার মধ্যে ৫০০ জনের মধ্যে ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছিল? 

আমি কিনা ভেবেছিলাম যেয়েই ঘোষণা দিতে হবে বোধহয় যে, আমরা অনুষ্ঠান ৯টার বদলে ১০ টায় শুরু করব!

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, আমি জাতীয় পর্যায়ের কোন অনুষ্ঠানেও এতটা ডিসিপ্লিন্ড দেখিনি।

৩০০ শিক্ষার্থী পিন পতন নীরবতায় মঞ্চের বকবক শুনছে, এরকমটা কোথায় দেখেছেন বলুনতো?

হয়তো আমি নটরডেমিয়ান এবং টেকনিক্যালিয়ান দু’টোই বলে, এতটা অবাক হয়েছি!


৭।

সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান করা হয়েছে সৈয়দপুর পৌরসভার টাকায়, তথ্যটা হজম করতে আমার প্রচন্ড বেগ পেতে হয়েছে।

শেষ কবে প্রশাসন থেকে আপনি এরকম সহায়তা পেয়েছেন?

সৈয়দপুরে এটি খুব-ই সম্ভব। মেয়র সাহেব সম্প্রতি ঝটিকা সফর করেন বাড়ি বাড়ি , যার বাড়ি সবথেকে পরিষ্কার থাকে, তাকে স্বর্ণালঙ্কার উপহার দেন! অসুস্থাবস্থায় বিছানায় শুয়ে সম্পূর্ণ কাজ করে দিয়েছেন । তাকে ধন্যবাদ দেয়া ধৃষ্টতা হবে।


আপনাদের হাত ধরে বদলাবে সবাই
ছবি: ওমেগা প্রাইম 


৮।

আমরা আজ শপথ করেছি, সৈয়দপুর সরকারি কারিগরি কলেজে উপহার দেয়া হয়েছে ডাস্টবিন।

আজ অনুষ্ঠানস্থলে সবাইকে কিছু বলার আগেই দেখি ,মোটামুটি ৬০ ভাগ ময়লা ডাস্টবিনে পড়েছে।

যদি পুরো অনুষ্ঠানে কোন আমার কোন ক্ষোভ থাকে তা হল, আমরা মোটেই অলিম্পিয়াডে সঠিকভাবে বিচার কাজ করতে পারিনি।

আমাদের এত কম প্রাইজ দেয়া মোটেই উচিৎ হয়নি। আমরা অত্যন্ত দুঃখিত!

তবে আমি সব খাতা সংরক্ষণ করছি। যাদের ভালো মনে হয়েছে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হবে সামনে।

ইনশাল্লাহ, এবছরের এইচএসসি ও ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত সব কাজ বন্ধ থাকলেও, সামনের দিনগুলোতে সৈয়দপুরের শিক্ষার্থীদের জন্য আরো অনেক আয়োজন থাকবে।

আমার জন্য পুরো আয়োজনটা ছিল একটা শিক্ষা সফরের মত। আমার কাছে জুনিয়ররা কি শিখবে, ওদের কাছেই আমি সারাদিন শিখেছি।

ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের এই এক সুবিধা, অসাধারন কিছু মানুষের আশেপাশে থাকা যায়।



ধন্যবাদ, ভলান্টিয়ার্স!
ছবি: কাম্রুজ্জামান ইমন 


ভলান্টিয়ার সবার সাথে পরিচয় হইনি, বিশেষ করে মেয়েদের সাথে তো একদম কথা হয়নি।

এজন্য দুঃখিত! ভবিষ্যতেও সব যেন এরকম মধুর থাকে।

আর ওমেগা প্রাইম-এর সবাইকে ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই। তোমরা তো ঘড়ের-ই মানুষ।

তারপরেও, আবারো সবাইকে অফিসিয়ালি আমার পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা।

আমরা জাগলে, দেশ জাগবেই!

‘We will make Saidpur great again!'

Comments

  1. ফন্ট ঠিক করো বাছা। এই ফন্ট নিয়ে পড়া শুরু করলে আদৌ শেষ হবেনা কোনদিন!

    ReplyDelete
  2. কিভাবে করে? :3 পারিনা।

    ReplyDelete
  3. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  4. we will make Bangladesh great again ;)

    ReplyDelete

Post a Comment