লুব্ধক

বড় হওয়ার কষ্টকর প্রক্রিয়াটির পুরোটাই যেন শুধু একের পর স্বপ্ন ভাঙ্গার, স্বপ্ন থেকে রুঢ় বাস্তবতায় ফেরার একটা দীর্ঘ যাত্রা।

বাচ্চাকালের নায়কদের কাছাকাছি গিয়ে আশাভঙ্গ, একের পর একজনকে বদলায়ে যাইতে দেখা, জ্ঞানের বহরকে সমুদ্রের বিশালতার দিকে না নিয়ে বদ্ধ পুকুরে আবদ্ধ করে কূপমণ্ডূক আর অর্বাচীন হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ভিড়ে একজন ব্যতিক্রম হলেন জুনিয়র মুদ্দাসসের-১ঃ ওমর ফারুক!  


ওমর ফারুক, বাম দিক থেকে প্রথম (শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস ২০১৩)



ওমর ভাই আমার জীবনের প্রথমদিকের আইডলদের একজন যার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এখনো কমেনি। প্রথম শিশু-কিশোর কংগ্রেসে, যখন আক্ষরিক অর্থেই শিশু ছিলাম তখন, তাঁর গবেষণাপত্রের উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, কী সুতীব্র আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর, ওমর ভাই সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন যথার্থই! সম্ভবত সেই থেকেই তাঁকে অনুসরণ করা শুরু। তারপর মাঝে শুধুমাত্র একটা গোটা সপ্তাহ তৃতীয় জগদীস চন্দ্র বসু ক্যাম্পের অলৌকিক বৃষ্টির দিনটাতে আমাকে না জানায়ে জনৈক মানুষের সাথে পুকুরে গোসল করতে যাওয়ার অভিযোগে কথা বন্ধ থাকা ব্যতীত এতগুলো বছর তাঁর সাথে কখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি।  

তারপর সময়ের আবর্তনে যখন নটরডেমে পড়তে চলে এলাম ঢাকায়, পুরো মুদ্দাসসের পরিবার হয়ে উঠলো আমার দ্বিতীয় পরিবার। হোস্টেলের মুরগী খেয়ে জিহ্বা বিমর্ষ, ওমর ভাই জানলে বলবে বাসায় চলে আয়, এবং সত্যি সত্যিই পরম মমতায় যতরকম সবজী পাওয়া যায় তা রান্না করে খাইয়েছিলেন! বই দরকার, মোটিভেশন দরকার, ঢাকার সার্ভাইভাল টিপস দরকার, সবকিছুর জন্যই আছে ওমর ভাইয়ের বিশেষ এবং নির্ভুল পরামর্শ। সম্ভবত তাঁদের কারনেই ঢাকায় থাকা আমার জন্য এত সহজ হয়েছিল। যাহোক সেইসব গল্প আমার “জীবনের বালুকাবেলায়” কিংবা “Chariot of life” গ্রন্থের জন্য তোলা থাক। 


ওমর ভাইয়ের কোন প্রোফাইলের বর্ণনায় একসময় লেখা ছিল যে আত্মবিশ্বাস দিয়ে উনি তাঁর অনেক ঘাটতি পূরণ করে ফেলতে পারেন। লেগে থাকা, এবং  “Never doubt that a small group of thoughtful, committed citizens can change the world; indeed, it's the only thing that ever has” এই কথাটা যে কত ভয়াবহ রকম সত্যি একটা কথা, তাঁর চাক্ষুস প্রমাণ ওমর ভাইয়ের কাজ দেখে পেয়েছি সবসময়! 

আমার দেখা সবথেকে স্মার্ট অথচ কোনরকম সংকীর্ণতা নেই এমন মানুষগুলোর মধ্যে একজন তিনি। কি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, অনলাইনের টুকরো কাজ, ভ্রমণ, অথবা বাস্তব জগতের কোন সমস্যা সবকিছুর জন্য প্রস্তুত অসম্ভব বিজ্ঞানমনষ্ক এবং আধুনিক এই ওমর ভাই, এবং অবশ্যই তাঁর বিখ্যাত হাসির সাথে।  

ডাকসু নির্বাচনের মনোনয়ন প্রাপ্তির পরে


২০১৯ সালের কোন এক দুপুরবেলা ক্লাস শেষে সম্ভবত মোকাররমে ওমর ভাই, আমি, আর ইশতিয়াক আকিব এর সাথে নিয়মিত দেশ-সমাজের আলোচনা হচ্ছিল।  ওমর ভাই যখন বলেছিলেন, “ডাকসু নির্বাচন আসছে, ক্যাম্পাসে অন্তত আলাপটা তোলা দরকার, সবাই তো আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছে যে এই নির্বাচনে কিছুই হবেনা...সারাজীবন কতকিছু পড়লাম এটা নিয়ে, এখন ঢাবিতে পড়ি আমাদের কিছু একটা তো করা দরকার!” এবং (আক্ষরিক ভাবে এরকমটাই বলেছিলেন তিনি) , আমি ঠিক শব্দ করে হাসতে পারছিলাম নাহ, কিন্তু মুচকি হাসছিলাম ওমর ভাইয়ের আত্মবিশ্বাস দেখে। আমি পজিটিভ মানুষ, কিন্তু তারপরেও কিছু করা সম্ভব হবে এটা কখনো ভাবিনি! কত দল এলো গেল, আমরা যারা কোন রাজনৈতিক দলেই নেই তারা আর কি করবো!



যাহোক তারপর আমি কি ভেবে যেন মানব ভাইয়ের কথা জানালাম তাঁদের, মানব ভাইয়ের সাথে মিটিং আয়োজন করা হল টিএসসিতে, অন্যদিকে একই দিনে “চায়ের কাপে ডাকসু” ফেসবুক ইভেন্ট হয়ে গেল, এবং মানব ভাইয়ের সাথে সেই মিটিং টাকেই বলা চলে স্বতন্ত্র জোটের জন্ম! 

আমার ডয়েচল্যান্ড থেকে আকিবের নিয়ে আসা নোটবুকের পাতায় মানব ভাই অরণি আপু, তৌহিদ তানজীম… সহ আরো যারা আমাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন তাঁদের ফোন নাম্বার লিখে দিলেন (ফান ফ্যাক্টঃ সেখানে বর্তমানে স্বতন্ত্র জোটের গভীর বিপক্ষ আতিক চৌধুরী সহ আরো অনেকের নাম্বার ছিল, ব্যাঙ ইমোজি হেহে!)





তারপর প্যানেল ঘোষণা, চায়ের কাপে ডাকসুর আয়োজন আরো বড় হতে থাকা, ১ মিনিটের ভিডিও, টকশো, ...অরণি সেমন্তি খান ম্যাজিক… নির্বাচন… “সন্ত্রাসীদের সাথে ছবি তুলিনা”... সেমাই খাওয়ানো… সবকিছু পেরিয়ে এখন সবাই জানে যেই স্বতন্ত্র জোটকে তাঁর শুরুটা কিন্তু ওমর ভাইয়ের ঐ কথা থেকেই শুরু! 

ইতিহাস-ই বলে দিবে এই জোটের অবস্থান কোথায় থাকবে ভবিষ্যৎ-এ, কিন্তু ওমর ভাইয়ের দেশের প্রতি যে প্রগাঢ় মমতা, যেটি কীনা নেহাত-ই সস্তা জাতীয়তাবাদ উদ্ভূত নয়, এবং তার সাথে তাঁর বিজ্ঞানমনষ্ক ও বাস্তববাদী যে সত্ত্বা, সেটি যে তুলনাহীন এবং ইতমধ্যেই একটা আলোড়ন তুলতে পেরেছে এবং সাধারণ ছাত্রদের রাজনীতি বিমুখীতা দূর করতে একটু হলেও ভূমিকা রেখেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 

স্বতন্ত্র জোটের প্যানেল ঘোষণা



At Least I can safely commend him as MY LEADER! Salud!



মাইক হাতে, সম্ভবত ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলনে



তবে এই রাজনৈতিক সত্ত্বাই নিশ্চয়ই তাঁর সবথেকে গুরুত্বপুর্ণ পরিচয় নয়। সম্ভবত আমার দেখা সব থেকে প্রখর তরুণ রাজনীতি সচেতন মানুষদের একজন না হলে, নিঃসন্দেহে আমার দেখা সবথেকে ভালো প্রেমিক হতেন অনন্য রুচিবোধের ধারক এবং বাহক ওমর ভাই। তাঁর মত রোমান্টিক মানুষও এই পৃথিবীতে খুব কম আছে ;) এবং আমার ব্যক্তিগত সন্দেহ (কিংবা নিঃসন্দেহ!) হল প্রেমের যত ক্লাসিক উপায় আছে, তাঁর সবগুলোই তাঁর জীবনে অফিশিয়ালি এবং আনঅফিশিয়ালি সংঘটিত হয়েছে। সে হোকনা লম্বা কাগুজে চিঠি লেখা, নক্ষত্ররাজির নিচে ফ্লার্ট করা, আর যথোপযুক্ত জায়গায় রাশান রসিকতা করা! 
এটি একটি কাল্পনিক ছবি, যার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই :3 শুধুমাত্র বর্ণনার স্বার্থে ব্যবহৃত :3 

তাঁর স্বপ্ন ছিল, একটা সময় দেখা হলেই জানাতেন, শান্তিনিকেতন যাওয়া। চাইতেন একজন বিজ্ঞানমনষ্ক, কিন্তু একইসঙ্গে রাবিন্দ্রীক কারো সাথে প্রেম করবেন। প্রত্যাশা করি বিশ্ববিদ্যালয় এর গণ্ডি পার হওয়ার আগেই তাঁর এই চাওয়া ‘অফিশিয়ালি’ বাস্তবে রূপ নিবে। 

দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে ভাবনাগুলোও যেন একটা আরেকটার থেকে সুন্দর তাঁর। যদিও আমি ধীরে ধীরে চলছি রুঢ় বাস্তবতা বিবর্জিত একদিকে, অন্যদিকে তিনি যেন দিনে দিনে রুঢ় বাস্তবতাকে আরো আপন করেই আগাচ্ছেন নিয়মিত। পড়ালেখা, রাজনীতি, সংগঠনের কাজ এতসবের মাঝেও জীবনকে উপভোগ করতে তাঁর জুড়ি নেই, সময় পেলেই একা একা চলে যান পাহাড়ে। রাতের আকাশে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ এর ভীষণ শখ (এবং দক্ষতা) আছে তাঁর, অন্ধকার রাতের আকাশ দেখলেই শুরু করবেন স্বাতী, সুরাইয়া, কিংবা কালপুরুষের গল্প অন্যদিকে ভালোবাসেন সত্যজিৎ, মুজতবা আলী, রাশান রসিকতা। 

এবং কতবিষয়ে দ্বিমত হয় তাঁর সাথে, কতবার হয়তো রাগারাগিও হয়েছিল এজন্য, এবং ততবার-ই যেন নতুন কিছু শিখেছি, নতুন ভাবে কিছু উপলব্ধি করেছি। 

জাফর ইকবাল বলতেন, “একজন বিখ্যাত মানুষ দিয়ে কিছুই হয়না, কিন্তু একশোজন ভালো মানুষ দিয়ে দেশ পাল্টিয়ে দেয়া যায়।” আমি একটু দ্বিমত করি। আমি বলি, শুধু ভালো মানুষ বা সৎ মানুষ হওয়াই যথেষ্ট নয়, দক্ষতাহীন সততা মূল্যহীন,  অনেকক্ষেত্রে ক্ষতিকারকও বটে। 

তাই বলতে চাই, বাংলাদেশের মত দেশের জন্য আমাদের অনেক জ্ঞানী-বিখ্যাত মানুষদের দরকার নেই, দরকার ওমর ফারুকদের মত বিজ্ঞানমনষ্ক, অথচ তীব্র মানবিক, মাটির গন্ধ বুকে নিয়ে রাজনীতি সচেতন তরুণদের। 

শুভ জন্মদিন, ওমর ভাই! 



আরো অনেক অনেকদিন আমাদের আপনাকে দরকার। জ্ঞানে, গুণে, প্রজ্ঞায় আরো অভিজ্ঞ হয়ে উঠুন, জীবনকে এভাবেই উপভোগ করতে থাকুন, একদিন আপনার স্বপ্নগুলোর অনেকগুলোই হয়তো বাস্তব হয়ে উঠবে। রাজনীতিই করতে হবে এমন নয়, আমি নিশ্চিত রাজনীতি করেন আর ইউনিসেফের অফিসার হন, অথবা বিজ্ঞানী, যেখানেই যাবেন আপনার সর্বাঙ্গীণ ভাবনায় থাকবে আমাদের অদ্ভুত এই দেশ আর তাঁর মানুষগুলো।   

একটাই অনুরোধ, রাগ কমাতে হবে :3

কতকিছু যেগুলো আগে ফর গ্রান্টেড ধরে নিয়েছিলাম, সেগুলো এখন আর হয়না, আপনার রান্না করা মজার সব খাবার খাওয়া, টিএসসির আড্ডা, দেশ-সমাজ-বই নিয়ে আলাপ…

আবার হবে, খুব শীঘ্রই, সেই আশা বেঁধে রাখি! ততদিন লুব্ধক হয়েই বেঁচে থাকুন! :) 

আবারো যেতে চাই এরকম কোন মফস্বলের ডাকবাংলোয়! 






Comments