ঈদ

ফেসবুকে কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, বরিশাল) লিখেছেন, ঈদ ❑ আমার কোন ঈদ নাই। এগার বছর আগে নামাজ পড়তে যাবার সময় আমার ঈদ চুরি হয়ে গেছে। আমি ঐদিন সবার মতো পাঞ্জাবি পরে নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। বাড়তি বলতে হাতে একটা তসবিহ ছিলো। সেই তসবিহ’র দিকে মন দিতে গিয়ে কোন ফাঁকে ঈদ হারিয়ে ফেলেছি টের পাই নাই। থানা পুলিশ করার মতো সঙ্গতি বাবার ছিলো না। তিনি বলেছিলেন মন খারাপ করিস না। সবার ঈদ থাকে না। এর চেয়ে আমার ঈদটা তুই নিয়ে নে। আমি বললাম আপনি ঈদ কোথায় পাবেন? আমি তো শুনেছি দাদা বেঁচে থাকতেই আপনার ঈদ হারিয়ে গেছে। বাবা অপরাধীর মতো বললেন তা ঠিক আছে, তবে তোর মায়ের ঈদটা আমি চুরি করে রেখেছি! কি বোধ থেকে লিখেছেন, কে জানে! কিন্তু তার পদ্য থেকে দু’ লাইন চুরি করে লিখতে চাই,
আমার কোন ঈদ নাই।  
এগার বছর আগে নামাজ পড়তে যাবার সময় আমার ঈদ চুরি হয়ে গেছে।
অনেককিছুই আজকাল বুঝতে পারিনা কখনো ঘটেছিল কীনা! জীবনের অনেক মূল্যবান, গুরুত্বপুর্ণ, এবং অনেক্ষেত্রে সুখের স্মৃতির অনেকগুলোকেই আজকাল মনে হয় কোন এক সুদূর অতীতের স্বপ্ন, যেই স্বপ্ন হয়তো কোনদিন দেখাও হয়নি আসলে! ভ্রম!

তবে বেশ মনে করা যায়, ঈদ ছিল একসময়। এবং, অনেক আনন্দময় ঈদ-ই ছিল আসলে।
সবকিছুর কেন্দ্রস্থান ছিল আমার গ্রামের বাড়ি, দাদুবাড়ি। আর কেন্দ্রীয় মানুষটা ছিল ছোটচাচা, প্রিয় আঙ্কেল—হয়তো আরো দশটা বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত পরিবারের মতই গল্প। তবুও, বলতে ইচ্ছা করে আমার ঈদ-ই ছিল সবথেকে আনন্দময়, আমার চাচা-ই ছিল সবথেকে ভালো।
ভাবতে অবাক লাগে, কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় ছিল আমাদের আনন্দের উপলক্ষ্য। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে গোসল করা, সে এক চ্যালেঞ্জ ছিল বটে, কারন সেসময় ঈদ হত শীতকালে! তারপর নতুন জামাকাপড় পরে ঈদগাহ পর্যন্ত হাটাহাটি করা, এবং সেমাই খাওয়া (সেমাই এ দুধের পরিমাণ কম হওয়া নিয়ে আমার চিৎকার চেঁচামেচি), তারপর নামাজ। সালামি দেয়ার ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে খুব শক্ত কিছু ছিলনা, হয়তো তখনকার পরিবারের আর্থিক অবস্থা করুণ হওয়ার কারনে। তাছাড়া তখনো ছোটচাচু ইউনিভার্সিটিতে পড়েন, তাই মেজচাচুর বিয়ে-চাকরি হওয়ার পরেই এই ব্যাপারটা শুরু হয় কিছুটা। সারাদিনে কোন সহৃদয়বান আত্মীয় স্বজন একটু সভ্য হলে তবেই কিছুটা মিলতো, বিশেষ করে ফুফু-ফুফাদের থেকে, ঐ টাকা দিয়ে কোমল পানীয় খাওয়ার থেকে বেশি আয়োজন সাধারণত হতোনা।
এদিকে নামাজের সময় অপেক্ষা শেষ হতোইনা। তাকবীরের পর যখন ভাবতাম নামাজ শেষ, তখন দেখতাম দীর্ঘ খুতবা শুরু হচ্ছে, আহা কি বিরক্ত লাগতো! তারপর একসময়ের দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে একসময় অবশেষে ছাড়া পাওয়া। তবে নামাজ শেষ হলেই মুক্তি ছিল এমনটা নয়! কবর জিয়ারত ছিল অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার একটা পারফেক্ট সমাবেশ। একদিক থেকে ভালো লাগতো, যেই দাদুকে কখন দেখা হয়নি তার সুখের জন্য কিছুটা দোয়া-কালাম করতে, অন্যদিকে তার সাথে অন্য সবার কবর ঘুরে আসতে এতদূর হাটতে হতো যা ভালো লাগতোনা।


এভাবে এক ঈদের পর অন্য ঈদ, বেগম খালেদা জিয়া থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন শেখ হাসিনা, পৃথিবী সূর্যকে কত হাজারবার প্রদক্ষিণ করলো, কতকিছুর বদল হল, কিন্তু এই কবর জেয়ারতের ঐতিহ্যটা কোনভাবে র‍য়েই গেছে!
অন্যদিক থেকে দেখলে, এখন মনে হয়, আসলে কবর জেয়ারতের এই দীর্ঘ যাত্রাটা আসলে আমাদের বড় হওয়ার একটা টাইমলাইন, প্রতিটা ঈদ—প্রতি ঈদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তন—যেন সময়ের ব্যবধানসমূহের একটা বাৎসরিক প্রতিচ্ছবি।
এইযে একসময় চাচুর হাত ধরে, ভাইয়ার পিছে, হাটতে হাটতে যেতাম। সেখানে একসময় যুক্ত হল মেজ চাচুর ছেলেরা, তারপর যুক্ত হল ছোট চাচুর ছেলে, এবং সর্বশেষ ঈদগুলোতে তারা যেত আমার পিছে পিছে বা কোলে! আবার, আগের ঈদে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ থাকতোনা পরের ঈদে! প্রতি ঈদের সাথে সাথে পারিবারিক অবস্থার উন্নতিটাও ছিল চোখে পড়বার মত, প্রতিবারই যুক্ত হত নতুন কিছু। বিশেষ করে ছোটচাচু যখন বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে চাকুরী শুরু করলো, এবং অবশ্যই নতুন আন্টি আসার পর। আন্টি ছিলেন ভীষণ মজার মানুষ, উচ্চশিক্ষিত, এবং বাচ্চাদের পাত্তা দেন, এমন মানুষ তো আসলে এর আগে তেমন ছিলনা পরিবারে।
অন্যদিকে মেজ চাচুকে অনেক রাগী ভাবতাম ছোটবেলায়। একবার তাই ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য রাতে বাতি জ্বালাতে গিয়ে যখন গলদঘর্ম হচ্ছিলাম তখন মেজচাচু যখন সাহায্য করলো লাইট লাগিয়ে দিতে, কী অবাকটাই না হয়েছিলাম! আমিও কিছু ঐতিহ্য যুক্ত করেছিলাম পরের দিকে। প্রতি ঈদে টিভি, এবং ক্রাউডফান্ডিং করে ভিসিডি ভাড়া করে নিয়ে গিয়ে হুমায়ুন আহমদের নাটক দেখা (সম্ভবত এভাবেই আমি সব সিঙ্গেল নাটকগুলো দেখে ফেলেছি তাঁর), এবং ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মানে কাজিনদের নিয়ে নাচ-গান-কবিতা-অভিনয় এসব। যদিও বেশ ভয়ে ভয়ে শুরু করা হয়েছিল, কিন্তু বেশ সাড়া পাওয়া গেছিল এতে। আমার এসব আয়োজনের আনন্দটা একটু বাড়তি হত, ছোটবেলায়, ঈদের পরদিনও গ্রামের বাড়িতে থাকার অনুমতি মেলায়, কারন বাবা-মা বাসায় চলে যেত (দশ কিলোমিটার মত দূরে) ঐদিনেই। এর সবকিছু হয়তো কোনভাবে শেষ হওয়ার-ই কথা ছিল। হয়তো ছোটচাচুর বিদেশ যাওয়াটা ছিল একটা উপলক্ষ্য মাত্র! কিন্তু… ঐ আসলে শেষ। এরপর থেকে বাকি ঈদগুলো মনে হত আনুষ্ঠানিকতা। আমাদের বাসাটা এমন এক জায়গায় ছিল যেখানে স্কুলের বন্ধুদের সাথে সৈয়দপুর শহরে ঈদ করবার মত ব্যপারও ছিলনা, আবার এলাকায়ও কোন এক কারনে হয়ে উঠতোনা, তাই গ্রামের বাড়িতেই যেতাম। ছোটচাচু বিদেশে যাওয়ার পর মনে আছে ভাঙা ভাঙা হাতে একটা লম্বা ইমেইল পাঠিয়েছিলাম অনেক কষ্ট পেয়ে, অনেককিছু লিখেছিলামও বটে (এখন যদিও কিছু মনে নেই!) অথচ কী অবাক কান্ড! ছোটচাচুর জন্য অপেক্ষা শেষ হল, অথচ ঈদ এলোনা জীবনে, সামনে আসবে বলেও আর মনে হয়না! এবছর চাচু দেশে ফিরলো, তবুও হলোনা! অবশ্য না হওয়ার আক্ষেপ তো এই প্রথম, এমন নয়। কেউ তো ভাবেনি তাঁদের স্বাভাবিক জীবন এভাবে থমকে যাবে এরকম সাধাসিধে নামের একটা বছরে! সামনের ঈদে দেশে কে থাকবে না থাকবে, কোথায় থাকবে, কে জানে!
এবং সম্ভবত যদি না কোন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে তবে দেশে আগামী কয়েকবছর অন্তত ঈদ-উল-ফিতর মিস করব এটা প্রায় নিশ্চিত, কেননা এই সময় দেশে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই! সেদিক থেকে এই ঈদ নিয়ে আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত, এবং সম্ভবত সন্তুষ্টি পেরিয়ে আনন্দেই আছি! চমৎকার দিন কেটেছে বেড়াতে গিয়ে। এখানে ঈদ ছিল গতকাল, কোন নামাজ হয়নি, সেমাই খাওয়াও হয়নি, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে বেশ ভালোই কেটেছে! অনেকদিন পর বেড়াতে গিয়েছিলাম, তাও আবার ট্রেনে করে(কোভিড-১৯ জনিত জরুরী অবস্থা চালু নেই, জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক এখন) দুপুরে খাওয়াও হল বাইরে, অনেকবছর পর আইসক্রিমও খেলাম, সারাদিন অনেক আনন্দে কাটলো। সম্ভবত বাংলাদেশের বন্ধু-বান্ধব কিছু থাকায় অনেক যন্ত্রণা থেকে বাঁচা গেছে এখানকার পুরো সময়টা! অন্তত আমার দুই চারটা খাঁটি বাঙলা রসিকতা, আর দেশ-সমাজ নিয়ে দুটো কথা, বোঝে সবাই :') তবে হুটহাট পদ্মায় চলে যাওয়া, আর বর্ষার অঝোর বৃষ্টির, কিংবা নেহাত-ই বৈশাখের আকাশ কালো করে আসা বৃষ্টির যেন কোন বিকল্প হচ্ছিলনা।

এখানে আসার পর মেঘের ডাক শুনেছি মাত্র একদিন। বৃষ্টি হল, ভিজতে গিয়ে আধভেজা হয়ে ফিরে এলাম রুমে কারন বৃষ্টি থেমে গেছে। অথচ কি চমৎকার কো-ইন্সিডেন্স! আজ বৃষ্টি হল, তাও আবার রীতিমত আকাশ কালো হয়ে, মেঘ ডাকাডাকি করে, আকাশে বজ্রপাতের ঝিলিক দেখায়েই আসলো। মুহূর্তেই পুরো পার্ক ফাঁকা! আর এদিকে আমি গায়ে টি-শার্ট টা রেখে ভিজছিলাম, ইচ্ছা করছিল, সবাইকে চিৎকার দিয়ে বলি, দেখ শালারা কীভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে হয় দেখ, বৃষ্টিতে ভিজতে জানিসনা,... "insert সেফাতুল্লাহর ডায়লগ"
এরপর ঠান্ডায় ঠকঠক করতে করতে এক কাপ কফি খেয়ে গরম হলাম। ইতোমধ্যে মোবাইলের অ্যাপে দেখি ১৫ কি.মি. হাটা হয়ে গেছে (রানিং ট্রাকে ২ কিমি স্প্রিন্ট সহ!)
বিরাট শুভ্র লেকের ওপর বৃষ্টি, হলুদ রঙের পদ্ম ফুটে আছে, হাস জলকেলি করছে, লোভ হচ্ছিল লাফ দিয়ে নেমে যাই। আইন কানুনের বাধা না থাকলে হয়তো যেতাম। এভাবেই চমৎকার একটা দিন কাটিয়ে ঘরে ফিরলাম রাত নয়টার দিকে। আসার সময়ও একটা মজার কাজ করলাম। যেই স্টেসনে নামার কথা তার এক স্টেসন আগে নামলাম গুগল ম্যাপকে ভরসা করে। এই রাস্তায় কখনো আসিনি, কোন জনমানব নেই, একটা বাড়ির দেয়াল ঘেষে জার্মান শেফার্ড তাকিয়ে দেখলো, সোডিয়াম লাইটের নিচ দিয়ে আসছি, পশ্চিম আকাশে তখন সন্ধ্যার আলোকচ্ছটা, একসময় বিল্ডিঙের সামনে পৌছালাম। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। ঘরে ফেরার অনুভূতি! সবমিলিয়ে ঈদ নিয়ে এখনো আলাদা করে কোন দুঃখ হচ্ছেনা। আগামীকাল আম্মা ফোন দিয়ে কান্নাকাটি না করলেই হয় এখন :3 ঈদ মোবারক!

Comments

  1. "ইচ্ছা করছিল, সবাইকে চিৎকার দিয়ে বলি, দেখ শালারা কীভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে হয় দেখ, বৃষ্টিতে ভিজতে জানিসনা" পড়ে যেন প্রাণের আরিফকে খুজে পেলাম। মনটাও ভরে গেল।
    ঈদ মুবারক আরিফ।

    ReplyDelete
  2. খাওয়া দাওয়া নিয়ে তো বিস্তারিত লিখলেন না ভাইয়া!
    ঈদ মুবারক!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ এত কষ্ট করে এই ফালতু কথাবার্তা শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য। জানিনা, তুমি ফেসবুকে আছো কীনা। ওয়েল, ব্যাপার হচ্ছে যে, কোঠাও লিখিনাই কিন্তু আসলে আমার ঈদ ছিল গতকাল। কারন পরীক্ষাও ছিল গতকাল সকালে, তাই তাঁর আগে রান্নাবান্না তেমন করা হয়ে উঠেনাই। কিন্তু গতকাল বিরিয়ানি সহ বাকি সব সুখাদ্য হয়েছে :') তাই মজা করে বলতেছিলাম গতকাল-ই ছিল আমার আসল ঈদ :D অবশ্য নকল ঈদের যে বর্ণনা উপরে দিয়েছি সেখানেও খাবার দাবার খারাপ ছিলনা, ম্যাকের আইসক্রিম আর বিগ ম্যাক ভালোই ছিল :3

      Delete
  3. দেশের বাইরে বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগে? ফালতু প্রশ্ন কিন্তু বৃষ্টি বলে কথা না করে থাকতে পারলাম না

    ReplyDelete

Post a Comment